ব্রহ্মার বরে ছিল ফাঁক, ফাঁকিটাই বুঝতে পারেননি উচ্চাকাঙক্ষী মহিষাসুর
পুরাণ অনুযায়ী, দানবমাতা দনু ছিলেন খুব উচ্চাকাঙক্ষী। যখন তাঁর বড় ছেলে রম্ভ অসুরলোকের অধিপতি, তখন দনু একদিন ডেকে পাঠান তাঁকে। বলেন, শুধু অসুরলোক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। স্বর্গ এবং মর্ত্যও জয় করতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে? মর্ত্যে মানবদের যুদ্ধে হারিয়ে দেওয়া কঠিন কাজ নয়। স্বর্গে তো দেবতারা থাকে। তারা খুব শক্তিশালী। উপায় বাতলে দেন মাতা দনু। রম্ভকে বললেন, নদীর ধারে গিয়ে অগ্নিদেবের প্রার্থনা করতে। আর এক ছেলে করম্ভকে বললেন, বরুণদেবের প্রার্থনা করতে। অগ্নি আর বরুণের মন পেলে যুদ্ধে বাকি দেবতারা পাত্তা করতে পারবে না, এটাই ছিল মাতা দনুর উপদেশ।
আরও
পড়ুন:
ছিল
রাজরাজড়ার
পুজো,
১৭৯০
থেকে
সর্বজনীন
হয়
দুর্গোৎসব
আরও
পড়ুন:
কলাবউ
গণেশের
বউ
নয়,
মহামায়ার
ভিন্ন
রূপ
আরও
পড়ুন:
কল্পারম্ভ
থেকে
সন্ধি
পুজো:
মাতৃবন্দনার
নানা
মাহেন্দ্রক্ষণ
মায়ের কথা শুনে রম্ভ আর করম্ভ গেলেন নদীর পাড়ে। রম্ভ নদীতীরে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে তপ করতে লাগলেন। আর করম্ভ বুকসমান জলে নেমে বরুণের স্তুতি করতে লাগলেন। দিন যায়, মাস যায়। দেবরাজ ইন্দ্র দেখলেন, এভাবে তপস্যা চললে তো ঘোর বিপদ! একটি কুমিরের রূপ ধরে তিনি কামড়ে ধরলেন করম্ভের পা। টেনে নিয়ে গেলেন জলের তলায়। সেখানে দু'জনে লড়াই হয়। মারা গেলেন করম্ভ।
এদিকে, রম্ভ নানা বাধা সত্ত্বেও তপস্যা শেষ করেন। সন্তুষ্ট অগ্নিদেব বর দেন যে, রম্ভের একটি পরাক্রমশালী পুত্রসন্তান হবে। সে-ই স্বর্গ, মর্ত্য ও অসুরলোকের একচ্ছত্র অধিপতি হবে।
ইতিমধ্যে রম্ভ এক সুন্দরীর প্রেমে পড়লেন। আসলে ওই মহিলা ছিলেন স্বর্গের অপ্সরা। অভিশাপের ফলে তাঁর আগমন ঘটে পৃথিবীতে। মানবীর পাশাপাশি মহিষী (মোষ) রূপ ধারণ করতে পারতেন সেই অভিশপ্ত সুন্দরী। রাজা রম্ভ তাঁকে বিবাহ করেন। রাণী মহিষী গর্ভবতী হওয়ার পর এক নতুন উপদ্রব এসে হাজির হয়। রম্ভের তপস্যার সময় মহিষী যখন পশুর রূপ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন এক মোষের সঙ্গে দেখা। মোষটি ছিল মায়াবী। অর্থাৎ যখন যেমন খুশি রূপ ধরতে পারত। মহিষীর রূপে মহিষ বরাবরই আকৃষ্ট ছিল। একদিন গর্ভবতী অবস্থাতে মহিষীকে সে অপহরণ করতে যায়। তখন ছুটে আসেন রাজা রম্ভ। তিনি বাধা দিলে জোর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মারা যান রম্ভ।
ব্যাঙ্গালোরের অদূরে মহীশূর শহরের চামুণ্ডী পাহাড়ে রয়েছে মহিষাসুরের বিরাট মূর্তি
যখন রম্ভকে চিতায় পোড়ানো হচ্ছে, তখন শোকে আকুল হয়ে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েন মহিষী। যমরাজ রাজা রম্ভের আত্মা ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি বাধা দেন। পতিব্রতা মহিলার জেদের কাছে হার মেনে যম পালিয়ে যান। এদিকে, রম্ভ নশ্বর শরীর ত্যাগ করেছেন। আত্মাও স্বর্গে যেতে পারেনি। তা হলে কী হবে? উপায় বাতলান মহিষী। তিনি নিজের পেটে স্থান দেন স্বামীর আত্মাকে। অর্থাৎ মহিষীর গর্ভস্থ সন্তান ছাড়াও তাঁর স্বামীর আত্মা পেটে লালিতপালিত হয়। স্বামীর আত্মার পুনর্জন্ম হয়। ইনি হলেন অসুর রক্তবীজ। আর রম্ভের ঔরসে যে সন্তানের জন্ম হয় যথা সময়ে, তিনি হলেন মহিষাসুর।
মাতা মহিষী হওয়ায় মহিষাসুর ইচ্ছে করলেই মোষের রূপ নিতে পারতেন। আবার দরকারে মোষের পেটেও লুকোতে পারতেন। মহিষাসুর খুব ধার্মিক ছিলেন। ব্রহ্মাকে তুষ্ট করেছিলেন। তাই ব্রহ্মার থেকে বর পেয়েছিলেন, কোনও পুরুষ তাঁকে মারতে পারবে না। যখন ব্রহ্মা জিজ্ঞেস করেন, "যদি কোনও মেয়ে তোমাকে প্রাণে মেরে দেয়?" মহিষাসুর তাচ্ছিল্য করে উত্তর দিয়েছিলেন, "পুরুষই যখন আমাকে মারতে পারবে না, তখন মেয়েদের থেকে কী ভয়? নারীরা দুর্বল। কোনও নারী আমাকে কী করে মারবে?"
অথচ মহিষাসুর ভেবে দেখেননি, ব্রহ্মার বরেই ছিল ফাঁক। কারণ দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি যদি কোনও নারীতে কেন্দ্রীভূত হয়, তা হলে তাঁর মরণ অবশ্যম্ভাবী। দম্ভের পর্দা তাঁর চোখের ওপর পড়েছিল। সেই পর্দা সরিয়ে বাস্তবটা বুঝতে অপারগ ছিলেন এই অসুররাজ।
অগ্নি ও ব্রহ্মার বরে বলীয়ান মহিষাসুর স্বর্গরাজ্য দখল করে নেন। ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা পালিয়ে বাঁচেন। তাঁরা ভগবান ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের স্মরণাপন্ন হন। সব শুনে এই তিনজন প্রচণ্ড রেগে যান। সেই রাগ চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসে তীব্র আলো হয়ে। তিনজনের চোখ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা আলো এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়ে এক তেজস্বিনী নারীর জন্ম হয়। বিষ্ণু এঁর নাম দেন চণ্ডিকা। এটা দেবী দুর্গারই উগ্র রূপ। ভয়ঙ্কর যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত নিহত হন মহিষাসুর।
চণ্ডিকা রূপে দুর্গা বধ করেছিলেন মহিষাসুরকে। আর কালী রূপে তিনি বধ করেন রক্তবীজকে।
মহিষাসুর রাজত্ব করতেন, তাই দক্ষিণ ভারতের একটা অংশ একদা পরিচিত ছিল মহীশূর রাজ্য নামে। এই মহীশূর রাজ্যই আজকের কর্নাটক। ব্যাঙ্গালোরের অদূরে মহীশূর শহরের চামুণ্ডী পাহাড়ে আজও রয়েছে মহিষাসুরের বিরাট মূর্তি। মহীশূরে মহিষাসুর নায়ক, খলনায়ক নন।