ভোট কমিশন যেন হীরক রাজা, ভোটকর্মীরা ফজল মিঞা বা বলরাম!
এখন ভোটপুজোর মরশুম। কে জিতবে, কত ভোটে জিতবে, কেন্দ্রে রাজনীতিক সমীকরণটা কী হবে, এ সব নিয়েই চলছে আলোচনা। আর গোটা প্রক্রিয়া যাঁদের ছাড়া সম্ভব নয়, সেই ভোটকর্মীদের অবস্থা নিয়ে খবরের কাগজে বরাদ্দ নেই এক সেন্টিমিটার জায়গাও। টিভি-তে নেই কোনও বাইট।
অথচ দেখুন, পঞ্চায়েত হোক বা বিধানসভা ভোট, ভোটকর্মীরা অপরিহার্য। আর এ তো লোকসভা ভোট। মহাযজ্ঞ।
ভোটকর্মী কারা? নিশ্চয় মঙ্গল গ্রহের জীব নয়। আমার-আপনার মতোই সাধারণ মানুষ। আপনার বাড়ির ছেলে, পাড়ার ছেলে। রাজকীয় স্বাচ্ছন্দ্যের দরকার নেই। কিন্তু নিরীহ ভোটকর্মীদের জন্য কি ন্যূনতম সুবিধার ব্যবস্থাটুকুও করে নির্বাচন কমিশন? খাতায়-কলমে ইয়া ইয়া ফিরিস্তি দিলেও বাস্তবে কিন্তু খামতি থেকে যাচ্ছে। কেন এমন অবস্থা, কে দায়ী বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার ভোট কমিশনের।
এখানে কতগুলি বিষয় উল্লেখ করলে বুঝতে সুবিধা হবে।
প্রথমত, এপ্রিল-মে মাসে প্রচণ্ড তাপে ভাজাভাজা হচ্ছে দেশের অধিকাংশ এলাকা। সেই গনগনে তাতে সারাদিন ঠায় বসে ভোট করাতে হয় ভোটকর্মীদের। শহরের দিকে যাঁরা ডিউটি করতে আসেন, তাঁরা তবুও বেঁচে গেলেন। কিন্তু গ্রামের দিকের অবস্থা তথৈবচ! পাকা ইস্কুল ভবন না থাকলে টিন বা টালির চালের ছাউনি দেওয়া লজঝড়ে ঘরে বসে ভোট নেওয়া। আগে ছিল দশ ঘণ্টা। সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা। এবার তা বেড়ে হয়েছে এগারো ঘণ্টা। সকাল সাতটা থেকে সেই বিকেল ছ'টা পর্যন্ত। ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা মায় বাংলার বাঁকুড়া, পুরুলিয়াতেও অনেক গ্রাম আছে, যেখানে এমন অবস্থা। কোথাও আবার পানীয় জলটুকুও টেনে আনতে হয় হুইই দূর থেকে। গরমে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাটুকুও থাকে না। অথচ ভোট কমিশনের বড় কর্তারা ঠান্ডা ঘরে বসে দিব্যি অ্যায়সা মেজাজ দেখিয়ে যান। ভারতের সেই হুজুর-গোলাম সংস্কৃতি আর কী!
দ্বিতীয়ত, ভোটকর্মীদের টানা দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে ভোট করাতে হয়। এই প্রচণ্ড গরমে সামান্য টিফিন করতে চাইলেও মেলে না বিরতি। চেয়ার ছেড়ে পাঁচটা মিনিট শৌচালয়ে গিয়েছে কী শুরু হয়ে যায় ভোটারদের খিস্তি। আর কোনও ত্যাঁদর ভোটার যদি ভোট কমিশনের কাছে অভিযোগ ঠুকে দেন তো হয়ে গেল! হীরক রাজার দেশের সেই ফজল মিঞা বা বলরামের অবস্থা হয়ে যাবে সংশ্লিষ্ট ভোটকর্মীর! শুধু মস্তিষ্ক প্রক্ষালন নয়, চাকরি জীবনেরও প্রক্ষালন করে দেবে ভোট কমিশন! এক্ষেত্রে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ খুব কম।
তৃতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। অবসরের মুখে থাকা একজন সরকারি কর্মীর (ভোট কমিশনের কোপ থেকে বাঁচাতে নাম গোপন রাখা হল) ডিউটি পড়েছিল গতবারের লোকসভা ভোটে। এই ব্যক্তি আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ভালোভাবে হাঁটতে চলতে পারতেন না। স্ত্রী তাঁকে রোজ ধরে ধরে অফিসে নিয়ে যেতেন। সারাক্ষণ অফিসে পাশে বসে থাকতেন। আবার ধরে ধরে বাড়ি নিয়ে আসতেন। এমন একজন অসুস্থ মানুষকে পোলিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মানবিকতার খাতিরে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে ভোট কমিশনের কাছে বিনম্র আবেদন করেন ওই বৃদ্ধ। আবেদন খারিজ হয়। ভোট কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্তা তাঁকে জানান, ভোটে যেতেই হবে। নইলে অবসরকালীন সব সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হবে। নেওয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। অথচ 'রিজার্ভ' থেকে অনায়াসে কোনও শক্তসমর্থ লোককে ডিউটি দেওয়া যেতে পারত। অথচ পাষণ্ড ভোট কমিশন সেই ভদ্রতাটুকুও দেখানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
সংবিধানের ২১ ধারাকে কি সম্মান দেবে না ভোট কমিশন?
চতুর্থত, আগে ভোটকর্মীদের নগদে হাতে-হাতে পারিশ্রমিক (অবশ্য একে 'ভিক্ষা' বললেও অত্যুক্তি হয় না) দেওয়া হত। এবার তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর চাওয়া হয়েছে। সরাসরি টাকা যাবে অ্যাকাউন্টে। এত পর্যন্ত শুনে মনে হবে, বাহ্, বেশ ভালো ব্যবস্থা। এবার বাকিটা শুনুন। ফের হুগলী জেলা থেকে একটি উদাহরণ তুলে দিই। ধরুন, রামবাবু একজন ভোটকর্মী। তাঁর অ্যাকাউন্ট রয়েছে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে। তিনি পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের একটি নির্দিষ্ট শাখার (যেখানে তাঁর অ্যাকাউন্ট রয়েছে) আইএফএস কোড-সহ অ্যাকাউন্ট নম্বর জমা দিলেন ভোট কমিশনের কাছে। এমন সবার অ্যাকাউন্ট নম্বর, আইএফএস কোড পাওয়ার পর ভোট কমিশন একটি খসড়া তালিকা তৈরি করল। দেখা যাচ্ছে, যার পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তাঁর অ্যাকাউন্ট নম্বর, আইএফএস কোড দেওয়া হয়েছে স্টেট ব্যাঙ্কের। আবার যার ব্যাঙ্ক অফ বরোদায় অ্যাকাউন্ট আছে, তারটা গুঁজে দেওয়া হয়েছে ইউনাইটেড ব্যাঙ্কে। বিভিন্ন জেলায়, রাজ্যেও এমন অবস্থা বলে অভিযোগ। অর্থাৎ পারিশ্রমিক কবে পাওয়া যাবে, আদৌ পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে ঘোর সংশয়ে ভোটকর্মীরা।
পঞ্চমত, ভোট শেষ হওয়ার পরও নিস্তার নেই। প্রতিটি এলাকায় একটি নির্দিষ্ট সেন্টার থাকে। এখান থেকে ইভিএম, ভোটের সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে হয়। আবার ভোট শেষে সেখানে তা জমা দিতে হয়। ভোট শেষে জমা দেওয়ার সময় সবচেয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা হয়। যতক্ষণ না সব বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ভোটকর্মীরা 'রিলিজ' পাবেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিশি গভীর হয়ে যায় 'রিলিজ' পেতে পেতে। তখন না পাওয়া যায় বাড়ি ফেরার বাস, না ট্রেন। ভোটের ডিউটি শেষ, অতএব ভোট কমিশনের গাড়িও তখন হাওয়া। অর্থাৎ গোটা রাতটা ফাঁকা আকাশের নীচে বা স্টেশনের বেঞ্চে শুয়ে কাটানো। এই অবস্থা পর্যবেক্ষণে কেন কোনও পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে না ভোট কমিশন?
ষষ্ঠত, ভোট কমিশনের এত অব্যবস্থাকে তবুও চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস দেখায় না কেউ। কারণ সংবিধানের ৩২৪ ধারা কিংবা 'পিপলস রিপ্রেজেন্টশন অ্যাক্ট, ১৯৫১' অনুযায়ী, নির্বাচন চলাকালীন একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করে ভোট কমিশন। কী জানি, যদি 'প্রক্ষালন' করে দেয়! কিন্তু, সংবিধানের ২১ ধারাকে কি সম্মান দেবে না ভোট কমিশন? তারা তো সাংবিধানিক সংস্থা! ২১ ধারায় কি জীবনের অধিকারের কথা বলা হয়নি? জীবনের অধিকার মানে তো শুধু প্রাণটা ধরে রাখা নয়, জীবনধারণের ন্যূনতম সুবিধাটুকু পাওয়া।
এমন ভাবনা যতদিন না ভাবছে ভোট কমিশন, ততদিন বুঝি এভাবেই চলবে। ভোটকর্মীদের মুখ খোলা দায়। মুখ খুললেই শাস্তির খাঁড়া, থুড়ি প্রক্ষালক।
আহাম্মক!