'রয়্যাল বেঙ্গল'-এর গুহা কাঁপিয়ে গেলেন 'কাগুজে বাঘ'
'দাঙ্গাবাজ' শব্দের বদলা 'ধর্মনিরপেক্ষতার গাইয়ে'!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগের জবাবে পাল্টা তোপ দাগলেন নরেন্দ্র মোদী। রবিবার বাঁকুড়া এবং আসানসোলের জনসভায় মেজাজে ভাষণ দিলেন তিনি। সারদা কেলেঙ্কারি থেকে টেট দুর্নীতি, 'ধর্মনিরপেক্ষ' পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের করুণ অবস্থা, সবই উঠে এলে বক্তৃতায়।
এদিন নরেন্দ্র মোদীর প্রথম জনসভাটি ছিল বাঁকুড়ায়। সকাল সাড়ে দশটায় আসার কথা থাকলেও তিনি এসে পৌঁছন পৌনে বারোটায়। বাঁকুড়া থেকে জনসভা সেরে আসানসোল পৌঁছতেও তাই অনেকটা দেরি হয়ে যায়। তাতে অবশ্য মানুষের উৎসাহে ভাটা পড়েনি। ঠা-ঠা রোদ্দুরে লোক দাঁড়িয়েছিল নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ শোনার জন্য। তাই দু'জায়গাতেই মানুষকে ধন্যবাদ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, মানুষের এত উৎসাহ দেখে তিনি অভিভূত।
গতকালই ডায়মন্ড হারবারে তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী বলে কোনও কথা হয়? বাচ্চা জন্মাল না, অন্নপ্রাশনের দিন ঠিক হয়ে গেল! লোক নেমন্তন্নও হয়ে গেল! যত সব পেপার টাইগার।"
এর জবাবে তিনি বলেন, "সারদা কেলেঙ্কারিতে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে। পথে বসেছে। কিন্তু দিদি আপনি কী করেছেন? চিটফান্ড বাংলাকে লুঠছে আর এই রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা বসে বসে হাততালি বাজাচ্ছে। কোথায় গেল সাধারণ মানুষের টাকা? কেন আপনি যথাযথ তদন্ত করছেন না? আমি না হয় কাগুজে বাঘ। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) এত ভয় পাচ্ছে কেন সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত নিয়ে? সাহস থাকলে দোষীদের এক্ষুণি জেলে ঢোকান।" তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে সিপিএমের সঙ্গে 'লোকদেখানো' ঝগড়া করে, সেটা দাবি করে তিনি বলেন, "প্রথম ইউপিএ সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল সিপিএম। আর দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শরিক ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। অর্থাৎ দু'জনেরই উদ্দেশ্য কংগ্রেসকে বাঁচানো। গোপনে বোঝাপড়া আছে এদের। এরা রাজ্যে করে কুস্তি আর দিল্লিতে করে দোস্তি।"
টেট দুর্নীতি নিয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিঁধেছেন নরেন্দ্র মোদী। বলেছেন, "বাংলায় শিক্ষকতার চাকরি পেতে গেলে ঘুষ দিতে হয়। অথচ গুজরাতে শিক্ষক নিয়োগের পুরো ব্যবস্থা অনলাইনে। কম্পিউটারই ঠিক করে দেয়, কারা চাকরির উপযুক্ত। ওখানে দাদা-দিদি ধরার ব্যাপার নেই। তাই স্কুলে চাকরি পেতে গেলে চার লাখ-পাঁচ লাখ টাকা ঘুষও দিতে হয় না। দিল্লিতে মা-ছেলের সরকার 'স্ক্যাম ইন্ডিয়া' তৈরি করেছে আর রাজ্যে 'স্ক্যাম বেঙ্গল' তৈরি করেছেন দিদি। আমার লক্ষ্য হল, 'স্কিলড ইন্ডিয়া' তৈরি করা।"
ভোট কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণকে বিঁধে বললেন,"আরও একটা মামলা ঠুকুন"
প্রসঙ্গত, ২৭ এপ্রিল শ্রীরামপুরের জনসভায় নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ১৬ মে-র পর বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে ফিরে যেতে হবে। জবাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "বাঙালিদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে বলছে, এত বড় সাহস! একজনের গায়ে হাত দিয়ে দেখুক!" বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী আর বাঙালি যে এক নয়, তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমোর সেই অজ্ঞানতা দূর করার চেষ্টা করে রবিবার নরেন্দ্র মোদী বলেন, "বাংলাদেশ থেকে দু'ধরনের লোক আসে। একদল যাদের ধর্মের ভিত্তিতে ওখান থেকে তাড়ানো হয়েছে। সব খুইয়ে মানুষগুলো এখানে বাঁচতে এসেছে। এরা শরণার্থী। এদের রক্ষা করব। আর একদল আছে, যারা চোরাপথে এদেশে এসে নানা গোলমাল পাকাচ্ছে। আমার দেশের তরুণদের কাজের সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। এরা অনুপ্রবেশকারী। এদেরকে তাড়িয়েই ছাড়ব।"
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'মুসলিম দরদী' ভাবমূর্তিকে পরিসংখ্যান সহযোগে নস্যাৎ করেছেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। বলেছেন, "আমাকে মুসলিম-বিরোধী বলে গালাগালি করেন দিদি। তা হলে শুনুন, গুজরাতে হজযাত্রীদের জন্য কোটা হল চার হাজার। আবেদন আসে ৪০ হাজার। আর পশ্চিমবঙ্গে হজযাত্রীদের জন্য কোটা হল ১২ হাজার। আবেদন আসে ১২ হাজারের কম। আমার প্রশ্ন, যদি গুজরাতে মুসলিমরা ভালো না থাকত, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না হত, তা হলে হজের জন্য এত আবেদন কেন পড়ত? কেন বাংলায় এই কোটা খালি থেকে যায়? বাংলার মুসলমানদের দুরবস্থার দায় কে নেবে? এই পরিসংখ্যান আমার মনগড়া নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের।"
তিনি আরও বলেছেন, "গুজরাতে মোট জনসংখ্যার ৮-৯ শতাংশ হল মুসলিম। বাংলায় সেটা ২০-২২ শতাংশ। গুজরাতের গ্রামে একজন মুসলিমের মাথাপিছু আয় হল ৭০০ টাকার বেশি। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে একজন গ্রামীণ মুসলিমের মাথাপিছু আয় ৫০০ টাকার কম। গুজরাতে একজন শহুরে মুসলিমের মাথাপিছু আয় ৯০০ টাকার বেশি। বাংলায় এটা ৭০০ টাকার কম। গুজরাতে প্রতি মুসলিমের ব্যাঙ্ক ডিপোজিটের পরিমাণ হল গড়ে ৩৫ হাজার টাকা। পশ্চিমবঙ্গে এটা গড়ে ১১ হাজার টাকা। গুজরাতে রাজ্য সরকারের বড় পদে রয়েছে ৮.৫ শতাংশ মুসলিম। অথচ পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারের বড় পদে রয়েছে মাত্র ১.২ শতাংশ মুসলিম। এর পরও কি বলা যায়, আগের বামফ্রন্ট সরকার বা এখন দিদি মুসলিমদের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে? এরা শুধু ভোটব্যাঙ্কের খাতিরে মুসলিমদের ব্যবহার করে। আমি নাকি সাম্প্রদায়িক! তা হলে ধর্মনিরপেক্ষতার গাইয়ে যারা যেমন কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেস কী করল?"
তাঁর দাবি, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গঠিত হলে বাংলার উন্নয়ন হবে। তখন তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও চাপে পড়ে রাজ্যের উন্নয়ন করতে বাধ্য হবেন। ফলে বিজেপি-কে ক্ষমতায় আনলে বাংলারই লাভ। ৬০ বছর ধরে মানুষ শাসক বেছেছে, এবার বাছুক সেবক।
আসানসোলের জনসভায় দাঁড়িয়ে সরাসরি নির্বাচন কমিশনকেও তোপ দাগেন নরেন্দ্র মোদী। বলেন, "বাংলায় গত ৩০ এপ্রিলের ভোটে যে রিগিং, সন্ত্রাস হয়েছে, তার পর বলব আপনারা ঠিক করে কাজ করতে পারেননি। আপনারা অকর্মণ্য। কেন্দ্রের প্রভুরা আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে জানি। কিন্তু দেশের কাছে আপনারা দায়বদ্ধ। তাই প্রভুদের কথা না ভেবে পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করুন। আমার এই কথা যদি আপনাদের খারাপ লাগে, তা হলে যান আরও একটা মামলা ঠুকুন আমার বিরুদ্ধে।"
ভাষণ শেষ করে যখন মঞ্চ ছেড়ে নামছেন তিনি, তখনও 'মোদী মোদী' বলে মানুষের চিৎকার চলছে। বাঁকুড়া ও আসানসোল, দু'জায়গাতেই একই ছবি দেখা গিয়েছে।