বাংলায় বিজেপির এই ফল কিভাবে? আসলে 'ক্লাস' এর বদলে বাঙালিও হিন্দুবাদী মূল্যবোধে মশগুল এখন
নরেন্দ্র মোদী প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী তখনও হননি। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছিলেন যে বাঙালিরা সাধারণত বিজেপিকে ভোট দেন না।
নরেন্দ্র মোদী প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী তখনও হননি। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছিলেন যে বাঙালিরা সাধারণত বিজেপিকে ভোট দেন না। তাঁর সেই মন্তব্য নিয়ে শোরগোল পড়ে; বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদকে তাঁর জন্যে কথাও শুনতে হয়।
বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, মোদী ফের বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় ফিরলেন। আর এবারে শুধু হিন্দি বলয়ে নয়, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেও জোরালো দাঁত ফোটাল গেরুয়াবাহিনী। রাজ্যের মোট ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে জিতল তারা, শাসকদল তৃণমূলের থেকে মাত্র ৪টি কম। রাজ্যের একসময়কার দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক বামেরা একটি আসনও পায়নি; কংগ্রেস পেয়েছে দু'টি।
এই ফলাফল দেখার পরে মনে হতেই পারে, তবে কি সেন মহাশয়ের পর্যবেক্ষণ ভুল কথা বলছে?
অমর্ত্য সেন ভুল কিছু বলেননি কিন্তু বাস্তব এবারে বদলে যাচ্ছে
আসলে সেন মহাশয় ইতিহাসগতভাবে কিছু ভুল বলেননি। স্বাধীনতার পর থেকে দেখলে তাঁর তত্ত্বকেই ঠিক বলে মনে হবে কারণ বিজেপি কোনওকালেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারেনি। তার কিছু কারণ ছিল। এক, বিজেপির হিন্দুবাদী রাজনীতির প্রকোপ বামশাসিত পশ্চিমবঙ্গের শ্রেণী-সচেতন ও ইন্টেলেকচুয়াল মানুষের মধ্যে সীমিত ছিল। এমন নয় যে বঙ্গীয় সমাজে ধর্মের জায়গা ছিল না, নাস্তিক বামেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের আড়ালে ধর্মও ছিল কিন্তু সেই ধর্মীয় আচার-আচরণে উত্তর ভারতের হিন্দু সংস্কৃতির ছাপ কম ছিল। বাঙালি ছিল শাক্তের ভক্ত; শিব বা গণেশের প্রবেশ তার সামাজিক-ধর্মীয় জীবনে সেভাবে আসেনি। পাশাপাশি সরস্বতীর পূজারী বাঙালি মেধাকেন্দ্রিক হওয়াতে উত্তর বা পশ্চিম ভারতের অর্থ-কেন্দ্রিক 'বানিয়া সংস্কৃতি' সেভাবে ঢোকেনি কখনও। অতীতে কংগ্রেসী আমলে পশ্চিমী উদারবাদী রীতিনীতি ও পরে বাম আমলে নাস্তিকতা এবং সামাজিক সাম্য ইত্যাদির আদর্শের মধ্যে প্রতিপালিত হওয়ার ফলে বাঙালি জনজীবনে বিজেপি বা আরএসএস-ধর্মী কার্যাবলীর প্রয়োজন পড়েনি।
নজরুল আস্তে আস্তে বঙ্গ জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকেন
কিন্তু এই চিরাচিরত ধর্মে ছেদ পরে বামেদের শেষের দিকে। ভোট যেহেতু বড় বালাই, বামেদের নজর পড়তে শুরু করে সংখ্যালঘুদের উপরে এবং ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে ওঠে পশ্চিমবাংলার গর্বের ধর্মনিরপেক্ষতা। নজরুলের গান আগে বঙ্গীয় সংস্কৃতির এক চেনা অঙ্গ হলেও পরে তা হারিয়ে যেতে থাকে। সুকান্তও ধীরে ধীরে মলিন হতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ চালু থাকেন অবশ্যই কিন্তু তাঁর শ্রেণী-সীমাবদ্ধতা এসে যায়। এরই মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস নামক একটি দলের জন্ম হয় শুধুমাত্র বামেদের হারানোর জন্যে, এবং রাজনৈতিক সুবিধে নেওয়ার কারণে একাধিকবার বিজেপির সঙ্গে হাত মেলান সেই দলের কান্ডারি তথা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে "দাঙ্গাবাজ" বললেও ভুলে চলবে না যে ২০০৪ সালেও দলের একমাত্র সাংসদ হয়ে মমতা যোগ দেন কেন্দ্রের বিজেপির এনডিএ সরকারেই -- এমনকী, ২০০২ সালের দাঙ্গা হওয়ার পরেও।
বিজেপির বিরোধিতা মমতাকে আরও কোণঠাসা করছে কারণ তাঁর নিজের প্রশাসনিক ব্যর্থতা
আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে সহ্য করতে পারছেন না কারণ তাঁর কাঁধে রাজ্যের সংখ্যালঘুদের ভার রয়েছে; যদিও সেই দায়িত্ব সামলানোর জন্যে যে বিজেপির সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। কিন্তু মমতা বেছে নিয়েছেন লড়াইয়েরই পথ এবং পুরো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই তিনি তাঁর বিজেপি-বিরোধিতার জন্যে দাওতে তুলে দিয়েছেন। কেন্দ্রের মোদী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার পথে গিয়েও তৃণমূল নেত্রী নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে আলাদা রাখতে পারতেন কিন্তু তা না করে তিনি যত সংঘাতের পথে গিয়েছেন মোদীর সঙ্গে, তাঁর নিজের পায়ের তলার মাটি সরেছে।
এর কারণ আর কিছুই নয়: প্রশাসক হিসেবে তাঁর ব্যর্থতা। আইন-কানুন, দুর্নীতি, দলতন্ত্রের বাড়াবাড়ি, রাজনৈতিক হিংসা, আর্থিক সংস্কার এর কিছুতেই কোনও অবদান মমতা রাখতে পারেননি। এর ফলে একদিকে ভদ্রলোক সমাজ যেমন তাঁর সরকারের উপরে খেপেছে অন্যদিকে মোদীরও সমর্থন বেড়েছে। তৃণমূল-বিরোধী যে ভোটাররা আছেন রাজ্যে, তাঁরা দেখেছেন যে বাম ও কংগ্রেসের পতনের পরে বিজেপিই একমাত্র বিকল্প আর তাই দলে দলে ভোট দিয়েছেন ওই দলটিকেই, রাজ্যে তাদের হাজারো দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও।
বাঙালির জীবনদর্শনেও ঘটেছে বদল; সরস্বতীর জায়গা নিয়েছে লক্ষ্মী
এরই মধ্যে আরও একটি চরিত্রগত বদলও ঘটেছে বাঙালি জীবনের। আগেকার মতো সরস্বতী-মেধার জায়গায় অধুনা-উদারবাদী দুনিয়ায় বাঙালির জীবনেও লক্ষ্মীর বসত বেড়েছে। অর্থ-কেন্দ্রিকতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাম নাস্তিকতা হ্রাস পেয়েছে; ডানপন্থী প্রবণতা বেড়েছে। উত্তুরে এবং পশ্চিমি সাংস্কৃতিক ছোঁয়ায় বাঙালিও হিন্দুবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী হয়েছে। এতে অন্যায়ের কিছু নেই কারণ সারা পৃথিবীতেই এখন ডানপন্থা-ধর্ম-অর্থ ইত্যাদির মিশেলে এক নয়া জীবন-দর্শন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং বিশ্বায়নের যুগে বাঙালিও তার বাইরে থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে কংগ্রেসি সংস্কৃতিকে ছুড়ে ফেলতে শুরু করে বাঙালিও; মহাত্মা গান্ধীর প্রতি তাদের রাগের কথা নতুন নয় আর যেহেতু বিজেপি মহাত্মার ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের ঠিক বিপরীতে অবস্থান করে, তাই তাদের আবেদনও বঙ্গে গ্রহণযোগ্যতা পায় সহজেই। বঙ্গীয় সমাজ জীবনে 'ক্লাস' ও 'ইন্টেলেকচুয়ালিজম'-এর এখন প্রভাব কমের দিকে; হিন্দুবাদী মূল্যবোধের মোড়কে জাতীয়তাবাদী জিগির এখন বঙ্গের উর্বর মাটিতেও মাথা তুলেছে। আর তাতেই কেল্লাফতে বিজেপির।