স্মৃতির অতলে বিস্মৃত 'বাংলার কলম্বাস'!
সে তো ছিল কল্পকাহিনী। কিন্তু বাস্তবে এক 'শঙ্কর' যে কেমন দাপিয়ে বেরিয়েছিল, সেই খবর ক'জন রাখে?
হেঁয়ালি থাক। সুরেশ বিশ্বাসকে চেনেন? আজ থেকে ১২৭ বছর আগে যিনি ব্রাজিলে গিয়ে যুদ্ধে লড়েছিলেন! বাঙালি যে ঘরকুনো নয়, বাঙালি যে ভীতু নয়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই লোকটি।
কে সুরেশ বিশ্বাস? ১৮৬১ সালে নদীয়া জেলায় জন্ম। যে বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়, তিনিও সেই বছর জন্মগ্রহণ করেন। বাড়ির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কৈশোরে খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। একদম যেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চাঁদের পাহাড়'-এর শঙ্কর। সেই রকম দামাল, তেমন সাহসী। যে লম্বা রেসের ঘোড়া, ছ্যাকরা গাড়ি টানা স্বভাব নয়!
কৈশোরে কিছুদিন কলকাতার একটি হোটেলে কাজ করেছিলেন। ১৪ বছর বয়সেই রেঙ্গুনে (এখন ইয়াঙ্গন, মায়ানমারের রাজধানী) পাড়ি দেন। কিন্তু সেখানে ভালো কাজ না পেয়ে চলে যান লন্ডনে। সেখানে কিছু ছুটকো কাজ করার পর কেন্টে একটি সার্কাসে চাকরি নেন। পশুদের প্রশিক্ষণের কাজ। সেখানেও মন বসেনি সুরেশবাবুর। জার্মানির হ্যামবুর্গে যান চাকরি নিয়ে। সেখানে এক রূপসীর প্রেমে পড়েন। কিন্তু 'কালা আদমি'-র সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ মেয়ের মেলামেশা মেনে নেয়নি সেকালের জার্মান সমাজ। তাদের চাপে জার্মানিও ছাড়তে হয় সুরেশ বিশ্বাসকে। তিনি চলে আসেনি আমেরিকায়। সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত গিয়ে হাজির হন ব্রাজিলে।
তখনকার ব্রাজিল আজকের মতো ছিল না। দুর্গম, ঘন জঙ্গলে ঢাকা। ১৮৮৭ সালে ব্রাজিলের সেনাবাহিনীতে চাকরি নেন সুরেশ বিশ্বাস। ১৮৮৯ সালে ব্রাজিলে স্বৈরাচারী রাজাকে উৎখাত করা হয়। ১৮৯৩ সালে ফৌজে লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন তিনি। ১৮৯৪ সালে সেখানকার নৌসেনাদের বিদ্রোহ দমনে সরকারকে সহায়তা করেন। যুদ্ধে তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে ব্রাজিল সরকার সুরেশ বিশ্বাসকে কর্নেল পদে উন্নীত করে। সেনাবাহিনীর কাজের পাশাপাশি তিনি কলেজে পর্তুগিজ ভাষায় পড়িয়েও রোজগার করতেন। স্থানীয় এক ডাক্তারের মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই সংসার পেতেছিলেন। ১৯০৫ সালে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে এই বীর বঙ্গসন্তান মারা যান।
ব্রাজিলে এই বঙ্গসন্তান এত জনপ্রিয় হন যে, লোকে তাঁকে এক ডাকে চিনত। সেই সময় রিও দি জেনেইরো শহরের একজন গণমান্য ব্যক্তি ছিলেন সুরেশ বিশ্বাস। ১৮৯৯ সালে তাঁর আত্মজীবনী বেরিয়েছিল। এ ছাড়া, ১৯০২ সালে এক পারিবারিক বন্ধু তাঁকে নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন। এই দু'টি ছাড়া সুরেশ বিশ্বাসকে নিয়ে আর লেখালিখি হয়নি।
আফ্রিকা থেকে শঙ্কর যখন ঘরে ফিরছিল, তখন তার মনে হয়েছিল, এই তো জীবন! এই দামাল জীবনই তো চেয়েছিল সে। হয়তো সুরেশ বিশ্বাসও জীবনের শেষ দিনগুলিতে একই কথা ভেবেছিলেন। তিনি যে 'বাংলার কলম্বাস'!